হিংস্র লম্পটেরা আরও সহিংস, ‘টার্গেট’ নারী

0 314

চট্টগ্রাম সংলাপ ডেস্ক: মৃত্যুদণ্ডে সর্বোচ্চ শাস্তি বেঁধে দিয়েও দেশে থামছে না ধর্ষণ। দেশের কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই মিলছে ধর্ষণের খবর। কিছু বর্বর এতটাই হিংস্র যে, ভিকটিমকে ধর্ষণের পর খুন করতেও দ্বিধা করছে না।

শুধু ধর্ষণই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে নারীর প্রতি অনেকভাবে সহিংসতা দেখছে দেশ। ভিকটিমকে একা ধর্ষণ নয়, ঘটছে দল বেঁধে ধর্ষণ বা গ্যাং রেপের ঘটনাও। ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে খুনের ঘটনাও নেহায়েত কম নয়। আবার ধর্ষণের অপমানে আত্মহত্যাও করেছেন অনেকে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হচ্ছেন। আবার এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন পুরুষও।

উত্ত্যক্তকরণের কারণে নারীর আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। অন্যদিকে যৌন হয়রানির ‘প্রতিবাদ করতে গিয়ে’ খুন হয়েছেন একাধিক নারী-পুরুষ।

দেশে ঘরে-বাইরে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারী। নির্যাতনের কারণে মৃত্যু ও আত্মহত্যার অভিযোগ রয়েছে অনেক। কিছু পরিবারে যৌতুকের জন্যও নির্যাতনের শিকার হতে হয় নারীকে। এক্ষেত্রেও শারীরিক নির্যাতনের পর আত্মহত্যা ও হত্যার অভিযোগও কম নয়।

নারী গৃহকর্মী হিসেবেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া নারীর দিকে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা এদেশে নতুন কিছু নয়।

সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজের বিশিষ্টজনরা বলছেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ধর্মীয় জ্ঞান ও মূল্যবোধের চর্চা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একইসঙ্গে কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করাও জরুরি।

পরিসংখ্যান কী বলছে

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) একটি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও দল বেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট এক হাজার ৩২১ জন নারী। এরমধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। যা ২০২০ সালে ছিল মোট এক হাজার ৬২৭ জন এবং ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪১৩ জন।

একই বছর (২০২১ সালে) বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ১২৮ জন নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন ৭৭ জন পুরুষ।

একইসময়ে উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ জন নারী ও ৫ জন পুরুষসহ খুন হয়েছেন মোট ৮ জন।

আসকের পরিসংখ্যান বলছে, গেল বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৬৪০ জন নারী। যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ৩৭২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন। এরআগে ২০২০ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৫৫৪ জন নারী।

অন্যদিকে ২০২১ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২১০ জন নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৭২ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেন ১৩ জন নারী।

গৃহকর্মী নির্যাতন ও অ্যাসিড নিক্ষেপের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের তথ্য উল্লেখ করে আসক জানায়, গেল বছর ৪৫ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পরে মারা যান ৩ জন নারী। এছাড়া অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ২৩ জন নারী।

বিশিষ্টজনরা কী বলছেন

দেশে কোনোভাবেই থামছে না ধর্ষণ। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় সবাই উদ্বিগ্ন। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ২০২০ সালে আইন পাস হয়েছে জাতীয় সংসদে। তবু ‘ধর্ষণ-উৎসবে’র লাগাম টানা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন? বিশিষ্টজনদের কথায় এর পেছনের বেশকিছু কারণ ‍উঠে এসেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, সমাজের স্তরে স্তরে সীমাহীন দুর্নীতি। সবক্ষেত্রে অনাচার, মানুষে মানুষে বৈষম্য, অবিচার, দুর্নীতি বাড়ছে। এর সঙ্গে ধর্ষণের সম্পর্ক আছে। সবগুলো বিষয় ধরে ধরে সমাধান করতে হবে। তা না হলে শুধু মৃত্যুদণ্ড বা শাস্তি দিয়ে ধর্ষণের হয়তো সাময়িক সমাধান হবে; স্থায়ী সমাধান হবে না।

তিনি বলেন, সামাজিক অন্যায়, অবিচার, আইন-কানুন, রীতিনীতি যদি খারাপ থাকে; যদি বৈষম্য বাড়তেই থাকে, দুর্নীতির দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে ধর্ষণের প্রতিকার হবে না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র ও জনগণ সীমাহীন দুর্নীতি, বৈষম্য, অবিচার ও অন্যায় সহ্য করে নিচ্ছে। ধর্ষণটাও সমাজ সহ্য করে নিচ্ছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, একটা মেয়ে ভিকটিম হওয়ার পর যদি মামলা করতে চায়, তখন সে বারবার ধর্ষণের শিকার হয়। সে থানায় যখন যায় তখন শিকার হয়, পত্রিকার লোকেরা যখন কথা বলে তখনও ধর্ষণের শিকার হয়।

খ্যাতনামা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, একজন বা একদল পুরুষ যখন ধর্ষণ করে তখন ওই নারীর ওপর তারা জয়লাভ করতে চায়। তাকে দলিত ও নিপীড়িত করে শ্লাঘা অনুভব করে। ধর্ষণের পর প্রমাণ মুছে ফেলার পাশাপাশি বিকৃত আনন্দ লাভের জন্য খুনও করা হয়।

দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে পর্নোগ্রাফিও একটা বড় কারণ বলে মনে করেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি শারীরিক-মানসিক নানা ক্ষতির কারণ হতে পারে।

ধর্ষণ ও প্রতারণা

সাম্প্রতিক সময়ে অনেক নারী সম্পর্কের অবনতি হলে প্রেমিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তুলছেন। অথচ তিনি স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। আবার অনেকে বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ধর্ষণের অভিযোগও করছেন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধারা ৯ (১) এর ব্যাখ্যায় ধর্ষণ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ছাড়া ১৬ বছরের বেশি বয়সের নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।’

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী রওশন আলী বলেন, পারস্পরিক সম্মতিতে প্রেমিক-প্রেমিকার শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ধর্ষণ— বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা ও আলাদা শাস্তির বিধান থাকা দরকার।

লোকলজ্জার ভয়ে আড়ালেই থেকে যায় অনেক ঘটনা

অনেক ভুক্তভোগী নারী লজ্জা ও ভয়ে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করেন না। প্রকাশিত অনেক ঘটনা আবার ধামাচাপা দেওয়া হয় ভয়-ভীতি ও অর্থের বিনিময়ে। আসকের তথ্য বলছে, এসবের পরেও গত দুই বছর দেশে ধর্ষণ মামলা হয়েছে দুই হাজার ৫৬টি।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, একজন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর শারীরিক-মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন তাকে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রাখা দরকার। অনেক পুরোনো সাক্ষ্য আইনে সেটা নেই। ভুক্তভোগীর জন্য নেই কোনো কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা। বরং ধর্ষণের সময় এমন এমন বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় যা ভিকটিমের জন্য একধরনের পীড়ন। এসব নানা কারণে অনেকে মামলা চালাতে চান না।

তিনি বলেন, আসামিপক্ষ সবসময় বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত করার চেষ্টা করে। তারা তাতে সফলও হয়। কারণ, এখানে করাপশনের (দুর্নীতি) সুযোগ আছে, পলিটিক্যাল বায়াসনেস (রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা) আছে। ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা রেপিস্টরা এসবের সুযোগ নেয়। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী কিন্তু একপর্যায়ে আপস করতে বাধ্য হয় অথবা পালিয়ে বেড়ায়।

প্রসঙ্গত, আইনে ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তির কথা বলা হলেও এসব ঘটনার দ্রুত বিচারের তেমন কোনো নজির এখনও স্থাপিত হয়নি দেশে। মামলা শেষ হতে কখনও কখনও ১০ থেকে ২০ বছর লেগে যাচ্ছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও সঠিক বিচারের অভাবও ধর্ষণের ঘটনা না কমার জন্য দায়ী বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।