‘টপলেভেল’ থেকে বস্তি, অন্ধকার জগতে এবার ‘লেডিলিডার’ দাপট

0 499

চট্টগ্রাম সংলাপ ডেস্ক: কয়েক বছর আগেও কাঁচাবাজার থেকে সবজি কুড়িয়ে বিক্রি করতেন কোহিনুর (৩৫)। খুব শখ ছিল অভিনয়ের। সেই শখ মেটাতে কিছু দিন কাজ করেন একটি নাটকের দলের সঙ্গেও। ব্যক্তিগত জীবনে একে একে করেন তিনটি বিয়ে।

সেই কোহিনুরের অপরাধের জগতে শুরুটা হয় ছোটখাটো কিছু ‘খ্যাপ’ দিয়ে। তবে সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। একপর্যায়ে ছিনতাইকারী, ডাকাত ও অপহরণকারীদের আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠেন কোহিনুর। গড়ে তোলেন অপরাধীদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই কোহিনুরের মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

কোহিনুরের মতো নারী অপরাধীরা এখন সমাজের উচ্চপর্যায় থেকে বস্তি, সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ছিনতাই, ডাকাতি, চুরি, অপহরণ, প্রতারণা, অবৈধ অস্ত্র বহন, মাদক বিক্রি ও মাদক বহন, মানুষকে অজ্ঞান করে টাকা-পয়সা কেড়ে নেওয়া ও জাল টাকা বহনসহ নানারকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন এসব নারী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য বলছে, চট্টগ্রামে এ ধরনের অনেক পেশাদার নারী অপরাধী বর্তমানে সক্রিয় রয়েছেন। বিভিন্ন সময় এরা অপরাধ করে ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে এসে আবার অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া বেশ কয়েকজন নারী অপরাধীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। সাধারণ মানুষকে প্রতারণায় ফেলে টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ হত্যার মতো অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছেন কিছু নারী। এসব নারী অপরাধীদের রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্কও।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অপরাধী সিন্ডিকেটের সদস্যরা নারীদের দিয়ে অপরাধ করার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়ার একটা সহজ কৌশল বলে মনে করে। এছাড়া নারীরা অনেক সময় সন্দেহের বাইরে থাকে। সেক্ষেত্রে এরা সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করে। অন্যদিকে এদের অন্তরালে পুরুষ সিন্ডিকেটের একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয়ভাবে মদদ দিয়ে থাকে।

সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে পুরুষ পকেটমারদের সঙ্গে নারী সদস্যদেরও সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। দুই-তিনজন কাজ করেন একসঙ্গে। আর সহযোগীর কাজ করে আরও তিন-চারজন।

আবার নানা কৌশলে ফ্ল্যাট বাসায় ঢুকে বাসার লোকজনকে অচেতন করে স্বর্ণালংঙ্কার ও নগদ টাকা পালিয়ে যায়, এমন চক্রেরও সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। এদের সঙ্গে স্বর্ণ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বাড়ির ভেতরের তথ্যদাতাও যুক্ত থাকেন।

সংঘবদ্ধ মোবাইল ফোন চোর চক্রেও এখন দেখা মিলছে নারী সদস্যদের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে গ্রেপ্তারও হয়েছেন এমন বেশ কয়েকজন নারী অপরাধী।

প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণার ঘটনা চট্টগ্রামে নতুন কিছু নয়। গত কয়েক বছরে নগরীর থানাগুলোতে ‘সুন্দরী নারীর ফাঁদে ফেলে’ ঘরে ডেকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায়ের অভিযোগ জমা পড়েছে অনেক।

পুরুষ অপহরণকারীদের সঙ্গে এখন অপহরণের মতো অপরাধেও জড়াচ্ছেন নারীরা। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে অপহরণকারীরা নারীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। বিত্তশালী পুরুষদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণ ছাড়াও শিশুদের অপহরণ করতেও অপরাধী সিন্ডিকেট নারীদের ব্যবহার করছে।

ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রেও এখন বেশ ‘পারদর্শী’ হয়ে উঠছেন অপরাধী চক্রের নারী সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তারও হয়েছেন তাদের কয়েকজন।

মাদক ব্যবসা ও বহনের মতো বড় অপরাধেও নারী জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব অপরাধীকে ধরতে অভিযান চালায়। এর মধ্যে কয়েকজনকে আটক করা হলেও অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান।

সরকারি হাসপাতালগুলোয় নবজাতক চুরির ঘটনা প্রায়ই ঘটে। আর এ কাজে বেশিরভাগ সময়ই হাসপাতালে কর্মরত পার্টটাইম আয়ারা জড়িত থাকেন। মূলত এই আয়ারা নবজাতক চুরির সিন্ডিকেটের একজন সদস্য।

জানতে চাইলে অপরাধবিজ্ঞানী ড. জিয়া রহমান বলেন, বাংলাদেশে নারী অপরাধীদের এক ধরনের ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার পুরুষের মতো কাজের সুযোগ না থাকায় নারীরা বাধ্য হয়ে অপরাধে জড়াচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সমাজে ইতিবাচক ইমেজ থাকায় নারী অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত হতে পারেন এমনটা কেউ বিশ্বাস করতে চান না।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ এ বি এম নাজমুস সাকিব বলেন, অপরাধীরা অপরাধ করার আগে চিন্তা করে কেমন ধরনের ঝুঁকি নিতে হবে এবং ধরা পড়লে কেমন সাজা হবে। তবে সাজার তুলনায় লাভের অঙ্ক বেশি হওয়ায় নারীরা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মাদক ও প্রতারণামূলক অপরাধে নারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

তিনি বলেন, সমাজে নারীদের সন্দেহের বাইরে রাখা হয়। এই সুযোগে নারীরা বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আগে পুরুষ অপরাধীরা নারীদের বিভিন্ন অপরাধে ব্যবহার করত। একসময় নারীরাও অপরাধে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পরে তারা নিজেরাও বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে।