সংকটের বৃত্তে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের বাজার

0 401

চট্টগ্রাম সংলাপ প্রতিবেদক: নানা সংকটে সংকুচিত হয়ে আসছে চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের বাজার। এখানকার ব্যবসায়ীরা এর নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল স্থাপনকে। নৌ পথে পণ্য পরিবহন কমে যাওয়া এবং সরু সড়কে দিনভর যানজটকেও দুষছেন অনেকে। এর বাইরে বর্ষা মৌসুমে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের জলাবদ্ধতার নামও উঠে এসেছে সমস্যার তালিকায়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের বাজারে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের বড় দারোগাহাটের ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেলের। আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আমদানিকারকরা চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে পণ্য গুদামজাত করে সারা দেশে সরবরাহ দিতেন। এখন সেইসব আমদানিকারকরা লাইটার জাহাজে করে নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে পণ্য আনলোড করছেন। কারণ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় কিংবা দেশের অন্য কোথাও পণ্য পরিবহনের একটি ট্রাকে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করা যায় না।

অন্যদিকে তিন বছর আগে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) স্লুইচ গেট নির্মাণের জন্য চাক্তাই খালের মোহনা প্রায় পুরোটা ভরাট করে ফেলায় নৌ পথে পণ্য পরিবহনেও ধস নামে। যদিও এখন নির্মাণাধীন স্লুইচ গেটের এক পাশ খুলে দেওয়ায় ছোট আকারের নৌকা খালে প্রবেশ করছে। বড় নৌকা খালে প্রবেশ করতে না পারায় সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার মতো জায়গায় পণ্য পাঠাতে হলে চাক্তাই খালের মোহনা পেরিয়ে পণ্য লোড-আনলোড করতে হচ্ছে।

এছাড়া চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে অবকাঠামোগত সমস্যা, চেক প্রতারণা ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। সরু সড়কে দিনভর যানজট লেগেই থাকে। কর্পোরেট সংস্কৃতির হাওয়ায় ইতোমধ্যে অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ এখান থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ছোট-বড় প্রায় ১০ হাজারের বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। বাপ-দাদার আমল থেকেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে এই বাজারের ব্যবসা পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর পাওনা টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। এতে বিশ্বাসের বাণিজ্য বিশেষত্ব হারাচ্ছে, আবার বাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

অন্যদিকে বর্ষা মৌসুম এলে জলাবদ্ধতা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমেও জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় দোকান ও গুদাম। জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা পেতে ব্যবসায়ীরা প্রায় দুই ফুট করে দোকান ও গুদামের তলা উঁচু করেছেন।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, খাতুনগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন স্কেল স্থাপন। দেশের আর কোনো মহাসড়কে ওজন স্কেল নেই। এটি চট্টগ্রামের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ বলে মনে করি। বিষয়টি নিয়ে আমরা ব্যবসায়ীরা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে বারবার আবেদন করেছি। শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কেন ওজন স্কেল থাকবে? আমাদের মনে হয়েছে, ওজন স্কেল স্থাপনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

চাক্তাই আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আহসান খালেদ পারভেজ বলেন, আস্থা ও বিশ্বাসের সংকটের কারণে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ থেকে অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া যানজট তো আছেই। জলাবদ্ধতার কারণে চালের বাজার ধীরে ধীরে পাহাড়তলীমুখী হয়ে যাচ্ছে। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা না গেলে এ অবস্থা হয়ত চলতে থাকবে।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জামাল হোসেন বলেন, বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটের কারণে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের আগের জৌলুস নেই। বিশ্বাসই ছিল খাতুনগঞ্জের লেনদেনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বছরের পর বছর এই প্রথাই চলে আসছিল। বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) বা চেকের বিনিময়ে বাকিতে দৈনিক ৮০০ থেকে হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন চলে এই ভোগ্যপণ্যের বাজারে। এক ব্যবসায়ী আরেক ব্যবসায়ীর টাকা মেরে উধাও হয়ে যাওয়া এবং চেক প্রতারণার বেশ কয়েকটি ঘটনায় সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। এছাড়া নৌ পথে পণ্য পরিবহনেও নেমেছে ধস। স্লুইচ গেটের নিচ দিয়ে বড় নৌকা প্রবেশ করবে কি-না, এটি নিয়েও ব্যবসায়ীদের মনে সংশয় রয়েছে। এছাড়া চাক্তাই খাল ও কর্ণফুলী নদী দখলে দূষণে বিপর্যস্ত। নৌ বাণিজ্যের স্বার্থে এই খাল-নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।