দুর্ঘটনার ফাঁদ যখন রেলক্রসিং!

0 495

চট্টগ্রাম সংলাপ প্রতিবেদক: নগরীর বেশ কয়েকটি রেলক্রসিং নানা কারণে দুর্ঘটনার বড় ফাঁদ হয়ে উঠেছে। রেলক্রসিংয়ের উন্নয়ন এবং লোকবল নিয়োগের জন্য বিভিন্ন সময় সুপারিশ করা হলেও তা উপেক্ষিত।

জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের পাশাপাশি চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে থাকা শত শত রেলক্রসিংয়ের অর্ধেকের বেশি অবৈধ। কোনো কোনো রেলক্রসিংয়ে লোকই থাকে না। কোনোটির জন্য লোকবল থাকলেও দায়িত্ব পালনে থাকে উদাসীনতা। আবার দশ-বিশ টাকা দিয়ে বদলি লোক নিয়োগের মতো দায়িত্বহীন কর্মকা-ও চলে। চট্টগ্রামসহ রেল পূর্বাঞ্চলের রেলক্রসিংগুলোতে ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন হচ্ছে কি-না না তার সুষ্ঠু তদারকি নেই। এতে করে বারবার ঘটছে দুর্ঘটনা, বারবারই প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। দীর্ঘ এই পথে মোট লেভেল ক্রসিং রয়েছে দুই হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৪০০টি বৈধ লেভেল ক্রসিং থাকলেও বাকিগুলো অবৈধ। দেশে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মোট অবৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ১৪১টি। ১ হাজার ৪০০টি বৈধ রেল ক্রসিং থাকলেও গেটম্যান রয়েছে মাত্র ৪৬৬টিতে। বাকিগুলো ‘ঠিকা’ লোকবল দিয়ে চালানো হয়। আবার অবৈধ রেলক্রসিংগুলোতে কোনো লোকবল নেই। এসব ক্রসিং একেকটি দুর্ঘটনার ফাঁদে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে মোট ১ হাজার ২৩০টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে বৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ৫১১টি। বাকিগুলো অবৈধ। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেলক্রসিং রয়েছে ২০৫টি। এর মধ্যে ১১০টি বৈধ।

চট্টগ্রামে মোট ৯৫টি অবৈধ ক্রসিং রয়েছে। পূর্বাঞ্চলের ৫১১টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে গেট ব্যারিয়ার আছে ২৫৭টির। এর মধ্যে ২২৯টি গেটে গেটম্যান থাকলেও বাকিগুলোতে কোনো গেটম্যান থাকে না। অবৈধ ক্রসিংগুলোতেও কোনো গেটম্যান নেই। চট্টগ্রামের ৯০০টির বেশি ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই, নেই ব্যারিয়ার।

চট্টগ্রামের অপেক্ষাকৃত দুর্বল রুট হিসেবে চিহ্নিত নাজিরহাট থেকে হাটহাজারী পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার রেলপথে প্রায় ২০টির মতো রেলক্রসিং থাকলেও লোকবল আছে মাত্র ২টিতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে কদমতলী রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রেললাইনে ২১টি ক্রসিং রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই অরক্ষিত।

রেলওয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, রেলওয়ে ক্রসিংগুলোকে চার ক্যাটাগরিতে শ্রেণীবিন্যাস করে থাকে। এগুলো হচ্ছে স্পেশাল, এ, বি ও সি ক্যাটাগরি। সাধারণ রেল জংশন, বিভাগীয় শহর ও বড় শহরের ভেতরের লেভেল ক্রসিংগুলো স্পেশাল এবং ‘এ’ ক্যাটাগরির। স্পেশাল ক্যাটাগরির লেভেল ক্রসিংগুলোতে ২৪ ঘণ্টাই তিনজন গেটম্যান পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন।

‘এ’ ক্যাটাগরির ক্রসিংয়ে থাকেন ২ জন করে গেটম্যান। ‘বি’ ক্যাটাগরির ক্রসিংগুলোর কোনোটিতে গেটম্যান আছে, কোনোটিতে নেই। কোনো গেটে ব্যারিয়ার আছে, কোনোটিতে নেই। ‘সি’ ক্যাটাগরির লেভেল ক্রসিং কার্যত পুরোটাই অরক্ষিত। এতে গেটম্যান কিংবা ব্যারিয়ার কিছুই নেই।

আবার অনেক স্থানে গেটম্যান থাকার পরও তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট গেটম্যান ধারে-কাছে গড়ে ওঠা বস্তির মানুষকে দশ-বিশ টাকা দিয়ে ব্যারিয়ার ফেলানোর দায়িত্ব দিয়ে নিজে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন।

সম্প্রতি খুলশী রেলক্রসিংয়ে একটি মর্মস্পর্শী দুর্ঘটনা ঘটে। ওই রেলক্রসিং রেলওয়ের একটি স্পেশাল ক্যাটাগরির ক্রসিং উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এই ক্রসিংয়ে তিনজন গেটম্যান পালাক্রমে ডিউটি করেন। একজনের ডিউটি আট ঘণ্টা। কিন্তু গেটম্যানদের দায়িত্বহীনতায় খুলশী ক্রসিংয়ে বড় ট্র্যাজেডি ঘটে গেছে। দায়িত্বে থাকা গেটম্যান স্থানীয় বস্তির একজন মানুষকে ব্যারিয়ার ফেলার দায়িত্ব দিয়ে নিজে অন্য কাজে চলে যান। বস্তির যে মানুষটি দশ-বিশ টাকা পাওয়ার আশায় কাজটি করতে সম্মত হয়েছিলেন তিনি ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করায় অঘটন ঘটে।

শুধু খুলশী রেলক্রসিং নয়, এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার মতো অনেক ক্রসিং রয়েছে চট্টগ্রামে। বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটলে এসব ক্রসিং নিয়ে আলোচনা হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কমিটি সুপারিশও করে। কিন্তু কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের রেকর্ড বেশি নেই। এতে করে বৈধ-অবৈধ সব ক্রসিং দুর্ঘটনার ফাঁদ হয়ে উঠেছে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনসার আলী বলেন, অনেকগুলো অবৈধ রেলক্রসিং আছে। বিভিন্ন এলাকায় অনেক প্রভাবশালী মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে রাতারাতি ক্রসিং তৈরি করে নেয়। এসব অবৈধ ক্রসিংয়ে আমাদের লোকবল নেই। এগুলো ট্রেন চলাচলের ক্ষেত্রে বড় হুমকি হয়ে রয়েছে। পূর্বাঞ্চলে স্থায়ী প্রায় চারশ গেটম্যানের পাশাপাশি ১ হাজার ৩৮ জন অস্থায়ী গেটম্যান কাজ করে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, পূর্বাঞ্চল লেভেল ক্রসিং গেটসমূহের পুনর্বাসন ও মানোন্নয়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এই প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে অবৈধ ক্রসিংয়ের অনেকগুলোকে বৈধ এবং বৈধ ক্রসিংগুলোতে লোকবল নিয়োগসহ মানোন্নয়ন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।