অনিয়মের চক্রে ওয়েল ফুড, নিয়ম ভাঙছে চট্টগ্রামের আরও যত ‘ব্র্যান্ড’

0 357

চট্টগ্রাম সংলাপ ডেস্ক: সাধারণ দোকান-বেকারির পাশাপাশি চট্টগ্রামের অভিজাত ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানেও এখন মিলছে ভেজাল ও অনিরাপদ খাবার। ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঝে মাঝে এসব দোকান-রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায়। অস্বাস্থ্যকর খাবার মিললে জরিমানাও করা হয়। কিন্তু সেই জরিমানার টাকা জমা করেই আবার অস্বাস্থ্যকর খাদ্য তৈরিতে নেমে পড়ে এসব প্রতিষ্ঠান। মাস-বছর পর ভ্রাম্যমাণ আদালত আবার সেই প্রতিষ্ঠানে গেলে খাবার তৈরিতে ফের মেলে অনিয়ম। এবারও জরিমানাতেই মাফ। কিছু টাকা জমা করেই পুরোনো অপকর্মে নেমে পড়ে একই প্রতিষ্ঠান!

জানা যায়, চট্টগ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠানেই খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, মজুত ও বিক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ মেলে ভুরি ভুরি। ভ্রাম্যমাণ আদালত এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিরতিতে অভিযান পরিচালনা করে। তবে সুফল মেলে কম। জরিমানা দিয়েই নিজেদের অপকর্মের দায় সারে এসব প্রতিষ্ঠান।

জরিমানাতেই দায় সারছে বড় ব্র্যান্ড

ইটিপি অকার্যকর রেখে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে পরিবেশ দূষণের দায়ে ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ওয়েল ফুড (প্রা.) লিমিটেড ও মেসার্স ফুলকলি অ্যান্ড কোং লিমিটেডকে ৭ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।

২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ওজন ও পরিমাপে কারচুপির অভিযোগে ওয়েল ফুডকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। রাজধানীর ওয়ারীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এ জরিমানা করা হয়।

একই বছরের ১৩ ডিসেম্বর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মিষ্টান্ন জাতীয় খাদ্যদ্রব্য ও বেকারিপণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাত করার অপরাধে ওয়েল ফুড কারখানাকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। নগরীর চান্দগাঁও থানার বিসিক কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকায় ওয়েল ফুড কারখানায় এই অভিযান পরিচালনা করা হয়।

তিনটি ঘটনাতেই উঠে এসেছে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় খাদ্য প্রস্তুতকারক ‘ব্র্যান্ড’ ওয়েল ফুডের নাম। তবে শুধু এই তিনটিই নয়। নগরীর জনপ্রিয় এই ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানে অভিযান চলেছে আরও বেশ কয়েকবার। অনিয়মের দায়ে করা হয়েছে জরিমানাও।

তবে শুধু ওয়েল ফুড নয়। চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকটি খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে খাদ্য তৈরিতে বড় ধরনের অনিয়ম পেয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসব প্রতিষ্ঠানকে করা হয়েছে মোটা অংকের জরিমানাও। তবে থামেনি ভেজাল মেশানো, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য তৈরি ও বিক্রয়।

ওয়েল ফুডের মতো নগরীর আরেকটি বড় খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বিএসপি ফুড প্রোডাক্টস। ভেজাল ঘি তৈরি করে একাধিকবার জরিমানা গুনলেও তা বন্ধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি র্যাাবের অভিযানে প্রতিষ্ঠানটির ৩ হাজার ৩৬০ কেজি ভেজাল ঘি জব্দ করা হয়। এসময় আটক করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলামকে।

এরআগে প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযান চালিয়ে ২০১২ সালে ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, ২০২০ সালে ২১ লাখ টাকা ও ২০২১ সালে ১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এছাড়া বনফুল, ফুলকলি, মধুবন, পিটস্টপ, হোটেল জামান, সাদিয়া’স কিচেন, হান্ডি, ঢাবা, মেজ্জান হাইলে আইয়ুন, কুটুম্ববাড়ি, হাইওয়ে সুইটস, ফ্লেভারস, মিঠাই, সিলভার স্পুন, কাচ্চি ডাইন, সিজলসহ চট্টগ্রামের জনপ্রিয় অনেক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে কোনো না কোনো অনিয়ম পেয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। নানা অভিযোগের দায়ে করা হয়েছে ছোট-বড় অংকের জরিমানাও। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে দুই থেকে তিনবার অভিযান চালিয়ে জরিমানা করার পরও থামেনি অনিয়ম। জরিমানা দিয়েই নিজেদের দায় সেরেছে এসব প্রতিষ্ঠান।

দেশজুড়ে প্রায় একই চিত্র

শুধু চট্টগ্রামই নয়। সারাদেশের চিত্রটাও খুব বেশি ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে (২০২০-২১) সারাদেশে এক হাজার ৫৩০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সংস্থাটি। এর মধ্যে কখনও একটি, কখনও একাধিক প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়েছে। তাতে দুই হাজার ৮৭০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় দুই হাজার ১৯৯ জনকে দণ্ড-অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কারাদণ্ড দেওয়া হয় ১৩১ জনকে।

অন্যদিকে দেশে অনিরাপদ খাদ্যের একটি শঙ্কাজনক তথ্য দিচ্ছে বিএফএসএ’র ল্যাব নেটওয়ার্ক দপ্তর। তাদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত অর্থবছরে (২০২০-২১) সারাদেশের বিভিন্ন বাজার থেকে মোট দুই হাজার ৭৬০টি খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে দুই হাজার ৩৫৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ২৬৮টি খাদ্যপণ্য পাওয়া যায় মানহীন।

এর আগের বছরও দুই হাজার ১১৯টি নমুনা সংগ্রহ করে এক হাজার ৭৩১টি পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১৯৬টি পণ্য পাওয়া যায় মানহীন। এই দুই তথ্যের হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বাজারে মানহীন পণ্যের সংখ্যা বেড়েছে।

এসব বিষয়ে বিএফএসএ চেয়ারম্যান আব্দুল কাইউম সরকার বলেন, মানহীন খাদ্য তৈরির প্রবণতা আমাদের মধ্যে বেশি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে নানা উপায়ে এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে। জেল-জরিমানা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে সচেতনতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে।

এদিকে এ নিম্নমানের ভেজাল খাদ্য এখন চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ভেজাল খাদ্যের কারণে প্রতিবছর দেশে কমপক্ষে তিন লাখ মানুষ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তায় বিএফএসএর পাশাপাশি গত তিন বছরে বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও র্যাইবসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আট হাজার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বলে তথ্য দিচ্ছে পবা। এসব অভিযানে ভেজালের প্রমাণ পাওয়ায় ২৫ হাজার মামলা ও কোটি কোটি টাকা জরিমানা আদায় করলেও দেশে ভেজালের কারবারে কোনো হেরফের হচ্ছে না।

তবে এত বেশি জরিমানা হওয়ার কারণ হিসেবে সরকারি কর্তৃপক্ষের কিছু দুর্বলতা রয়েছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দীন। তিনি বলেন, এত ছোটখাট বিষয়ে জরিমানা করা হচ্ছে যে সেগুলোর কারণ খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। বলতে গেলে কথায় কথায় জরিমানা গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

তিনি বলেন, ভেজালবিরোধী অভিযান নিয়ে এত বেশি নেতিবাচক প্রচারণা হয়, যার কারণে ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। ফ্রিজে পড়ে থাকা কোনো খাদ্য উপকরণ একটু দুর্বল হতেই পারে, কিন্তু সেটার জন্য জরিমানা, কর্মীদের স্বাস্থ্যসনদের জন্য জরিমানা, এসব বিষয় যেন প্রহসন। নানা অজুহাতে প্রতিষ্ঠানগুলো পড়ছে জরিমানার মুখে, নষ্ট হচ্ছে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম।